বর্ণপরিচয়
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো ভাষা। তবে মুখের ভাষা দীর্ঘস্থায়ী নয়, তাই লেখার প্রয়োজন তৈরি হয়। এই লেখাই ধীরে ধীরে রূপ নেয় বর্ণপরিচয়ে। বর্ণপরিচয় বা বর্ণমালার আবিষ্কার কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের চিন্তা, চর্চা ও যোগাযোগের প্রয়োজন থেকেই গড়ে উঠেছে।
প্রাচীন কালের লেখার সূচনা
প্রথমদিকে মানুষ প্রতীক বা চিত্রের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩৪০০ সালে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়রা ‘কিউনিফর্ম’ নামক চিত্রলিপির মাধ্যমে লিখতে শুরু করে। একই সময়ে মিশরে ব্যবহৃত হতো হায়ারোগ্লিফিক্স, যা ছিল চিত্রভিত্তিক প্রতীক লিপি। যদিও এগুলো ছিল লেখার আদিম রূপ, কিন্তু এখনকার মতো ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালা ছিল না।
ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালার উদ্ভব
লেখার জগতে একটি বিপ্লব ঘটে ফিনিশীয়দের মাধ্যমে, যাঁরা খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১২০০ সালে প্রথম ধ্বনিভিত্তিক বর্ণমালা তৈরি করেন। এটি ছিল ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে গঠিত একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণমালা। পরবর্তীতে গ্রিকরা এই বর্ণমালাকে গ্রহণ করে এবং তাতে স্বরবর্ণ যুক্ত করে। গ্রিকদের হাত ধরে এই বর্ণমালা রোমান (ল্যাটিন) লিপিতে রূপ নেয়, যেখান থেকে আজকের ইংরেজি বর্ণমালার জন্ম।
বাংলা বর্ণমালার ইতিহাস
বাংলা বর্ণমালার মূল উৎস হলো ব্রাহ্মী লিপি, যা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হতো। ব্রাহ্মী থেকে ক্রমান্বয়ে সিদ্ধম, নাগরী, এবং বঙ্গাক্ষর উদ্ভূত হয়। এই বঙ্গাক্ষরই পরে রূপ নেয় আধুনিক বাংলা লিপিতে। বাংলা বর্ণমালায় রয়েছে ১১টি স্বরবর্ণ, ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ এবং অসংখ্য যুক্তাক্ষর।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
বাংলা ভাষার শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৫৫ সালে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত পাঠ্যবই “বর্ণপরিচয়”, যা শিশুদের জন্য বাংলা বর্ণমালা শেখার একটি সহজ ও কার্যকর উপায় হিসেবে গড়ে ওঠে। তিনি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণকে সহজভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করেন, যার ফলে শিশুদের শেখার পথ সুগম হয়। তাঁর এই কীর্তি আজও বাংলা ভাষা শিক্ষার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উপসংহার
বর্ণপরিচয়ের ইতিহাস আসলে মানব সভ্যতার জ্ঞান ও চিন্তার বিকাশের ইতিহাস। এটি কোনো একদিনে বা একজন মানুষের মাধ্যমে হয়নি। তবে বাংলায় প্রথম সংগঠিত ও কার্যকর বর্ণপরিচয়ের সূচনা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে। তাঁর অবদান বাঙালি জাতির শিক্ষার ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
Comments
Post a Comment